শনিবার, ৩০ মে, ২০১৫

বার বার হেরে যাবার গল্প

Collected From- https://www.facebook.com/tahsinmashroofhossain/posts/830821353620253

দুহাজার তিন সালে সায়েন্স গ্রুপ থেকে আমি এইচ এস সি পাস করি, 3.60 আউট অফ 5 এর ভয়াবহ সিজিপিএ নিয়ে| ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম, আন্ত: ক্যাডেট কলেজ প্রতিযোগিতাগুলোর কারণে প্রায় সবাই চিনত| ক্যাডেট কলেজের শেষ এক বছর এক্সট্রা কারিকুলামই শুধু করেছি, কারিকুলামটা আর করা হয়ে ওঠেনি| সায়েন্স বিভীষিকার মত লাগত, বিশেষ করে কেমিস্ট্রি| আমার বড় চাচা কেমিস্ট্রি গোল্ড মেডালিস্ট শিক্ষক, কেমিস্ট্রিকে বাবা বলতেন "পারিবারিক সাবজেক্ট"| সেই কেমিস্ট্রিতে পেলাম বি মাইনাস, ম্যাথে সম্ভবত সি|
এইচ এস সি পরীক্ষার রেজাল্টের পরের দু মাস ছিল রীতিমত নরকসম| সফল কোন আত্মীয়/বন্ধুর মা ফোন করতেন আমার মা কে, দূর থেকে অপরাধীর মত শুনতাম আম্মুর কণ্ঠ- "না ভাবী, আমার ছেলে ভাল করেনাই, পাস করেছে কোনরকম"| টপ টপ করে চোখ বেয়ে পানি পড়ত, আমারও, আম্মুরও- কিন্তু যন্ত্রণার সেটা কেবল শুরু|
ইংরেজিতে কিছুটা ভাল ছিলাম, প্রাণপণ চেষ্টা শুরু করলাম আইবিএ এর জন্যে| দিনে বারো থেকে আঠের ঘন্টা পড়াশোনা, ফলাফল হল অশ্বডিম্ব- লিখিত পরীক্ষাতেই টিকলাম না| আইবিএ রেজাল্টের পর মোটামুটি গৃহবন্দীতে পরিণত হলাম- আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে সারাজীবন যাকে তৃতীয় শ্রেনীর গর্ধব বলে জেনেছি, তিনিও আব্বু আম্মুকে ফোন করে জ্ঞান দেয়া শুরু করলেন- আপনার ছেলের কি হবে এখন?
আমাদের সমাজটা কেন জানি ব্যর্থদের প্রতি প্রচন্ড নির্মম| জীবনের কোন একটা লড়াইয়ে আপনি হেরেছেন কি মরেছেন, হায়েনার দল ওত পেতে বসে আছে আপনার দগদগে ঘা তে মরিচগুঁড়ো সহকারে লবন দেবার জন্যে|কেউ একটিবারের জন্যে আপনার ক্ষতবিক্ষত বুকে হাত বুলিয়ে বলবেনা, " ধুর বোকা, ভেঙে পড়ার কি আছে, এ লড়াই তো শেষ লড়াই না!"
আঁধারের মাঝে আলোকচ্ছটা হয়ে এল আমার আইএসএসবি তে টেকা, তাও সেটা মাত্র কয়েক মাসের জন্যে| বিএমএ যাবার তিন মাসের মধ্যে বুঝতে পারলাম, প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ম মেনে চলা কঠোর এ সেনাজীবনের উপযুক্ত আমি নই| স্বেচ্ছায় চাকুরি ছেড়ে চলে আসার দিন প্লাটুন কমান্ডার মেজর এম বলেছিলেন- You are just a goddamn failure.You have failed here, I can write down in the stamp paper that you will never succeed anywhere in your life.
আর্মিতে যাবার আগে শেষবারের মত জীবনের "রঙ" দেখতে নর্থ সাউথে পরীক্ষা দিয়েছিলাম, ওটাই শেষে ঠিকানা হল| প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ি শুনে আত্মীয় স্বজনদের মধুর মন্তব্য- "বাপের টাকা আছে দেখে করে খাচ্ছে, নাহইলে তো রাস্তায় ইঁট ভাঙারও যোগ্যতা ছিলনা| জানি তো, আর্মি থেকে লাত্থি মেরে বের করে দিয়েছে!"
নর্থ সাউথের পারফরম্যান্সও তথৈবচ, প্রথম দু সেমিস্টারে ছটা সাবজেক্টের পাঁচটায় ফেইল, আরেকটায় সি মাইনাস| এরপর জোর করে কিছুটা পড়াশোনা করে পাস করলাম সাড়ে তিনের কাছাকাছি সিজিপিএ নিয়ে, আমার ডিপার্টমেন্টের ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় যেটা আহামরি কিছুই না| অর্থনীতির ছাত্র,কিন্তু ইংরেজিতে কিছুটা দখল থাকায় চাকুরি হল ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে, টিচিং এ্যাসিস্টেন্টের কাজ|
আমার বন্ধুরা একে একে বাইরে পড়তে গিয়েছে , কিন্তু আমার সে যোগ্যতা ছিল না| ঠিক করলাম বিসিএস দেব, বাবার মত সরকারী চাকুরি করব|
"এনেসিউ তে পড়ে বিসিএস? বাবা, ওসব জায়গায় টেকা প্রাইভেটের ছেলেপেলের কম্মো না, যাও বাপের বিজনেসে বসো গিয়ে, নইলে মামা চাচা ধরে দেখ কোন কোম্পানিতে ঢুকতে পারো কিনা| মাল্টিন্যাশনালে ঢোকা তোমার যোগ্যতায় কুলাবে না, দেখলাম তো"
প্রিয় পাঠক, আজকে আপনারা আদর করে আমাকে সুপার কপ ডাকেন| মাত্র পাঁচ বছর আগেই আমাকে প্রতিনিয়ত উপরের কথাগুলো শুনতে হয়েছে|
বিসিএস পরীক্ষার রেজাল্ট হল, ফরেন সার্ভিস পেলাম না| রেজাল্ট খারাপ হয়নি, পুলিশ ক্যাডারের মেধাক্রমে চতুর্থ হয়েছিলাম| তবু জেনে গেলাম, ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট হিসেবে কোনদিনও আমি জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে লাল সবুজ পতাকার প্রতিনিধিত্ব করতে পারছিনা| বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা পরম মমতায় লালিত স্বপ্নের কি করুণ অপমৃত্যু!
পুলিশ একাডেমিতে যাবার আড়াই মাসের মাথায় হঠাৎ একদিন দুবছর ধরে স্বপ্ন দেখানো মেয়েটি জানালো, পুলিশের চাকুরি করা কারো সাথে বাকি জীবন কাটানো তার পক্ষে সম্ভব না, শি ইজ ডেটিং সামওয়ান এলস!
প্রথম প্রেম ছিল ওটা, ওকে ছাড়া কাউকে কল্পনাও করতে পারতাম না| উফ, কি কষ্ট, কি ভয়াবহ কষ্ট! মনে হত শত শত বিষাক্ত কেঁচো আমার ভেতরের সবটুকু প্রাণ শুষে নিয়েছে!
দুবছর যাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছি, পুরো স্বপ্নটুকু নিষ্ঠুরের মত ছিঁড়ে ফেলার যন্ত্রণা কেবল আমিই জানি| আমার ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড ছিল ওর নামে| হাউমাউ করে দরজা আটকে কি কান্নাটাই না কেঁদেছিলাম ওটা বদলানোর সময়!
মজার ব্যাপার, হৃদয়ঘটিত কষ্টের ঘটনাক্রমে এ ঘটনাটির স্থান প্রথম নয় আমার জীবনে| প্রথমটির গল্প অন্য কোন দিন, যেদিন আমি আরেকটু শক্ত হব তখন|
পুলিশ একাডেমি থেকে পাস আউট করার পর সিলেক্টেড হলাম মাননীয় প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর দেহরক্ষী বাহিনী স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সে| সেখানেও যোগ দেয়া হলনা, পুলিশ বিভাগে আমার আইডল বেনজীর স্যার আমাকে নিয়ে এলেন ডিএমপি হেডকোয়ার্টারে| সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর গেলাম উত্তরায়, এসি (প্যাট্রোল ) হিসেবে| ফেসবুকের পোকা ছিলাম তখনো, পিএটিসিতে ফাউন্ডেশন ট্রেনিং-এ শেখা "কাইজেন" (KAIZEN) পদক্ষেপ হিসেবে উত্তরাবাসীকে পুলিশি সহায়তা দিতে খুলে ফেললাম ছোট একটা ফেসবুক পেজ|
বাকি গল্পটা আমার পরিচিত অনেকেই জানেন, পুনরাবৃত্তি করে আর বিরক্তি উৎপাদন করছিনা|
এবার মজার কিছু তথ্য দেই:
1) প্লাটুন কমান্ডার ভদ্রলোকের সাথে আরেক জায়গায় দেখা হয়েছিল| বেনজীর স্যারের সাথে গাড়ি থেকে আমাকে নামতে দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিলেন তিনি, আমি মিষ্টি করে একটা হাসি দিয়েছিলাম মাত্র|
2) গত বছর আইবিএ তাদের অভিজাত Brandedge ম্যাগাজিনে আমার একটা সাক্ষাতকার ছাপিয়েছিল| ম্যাগাজিনটা হাতে পেয়ে কেন জানি আনন্দিত হইনি, আইবিএ রেজাল্টে বাদ পড়া রক্তহীন মুখে দাঁড়ানো সেই কিশোরটার মুখ বড্ড চোখ ভিজিয়ে দিচ্ছিল| ম্যাগাজিনে ছাপানো নিজের ছবিটা দেখেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না
3) জাপানের সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল Tokyo Institute of Technology এর গেইটে পা রেখে প্রথম যে কথাটি মাথায় এসেছিল তা হচ্ছে, বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দেবার মত সিজিপিএ আমি এইচ এস সি তে পাইনি|
আমি এমন এক বাবা, যে তার দুমাসের অনাগত সন্তানকে বাঁচাতে পারিনি| কষ্টটা ভুলে থাকি কিভাবে জানেন?
এই আপনাদের নিয়ে|
সবশেষে এই বার বার হেরে যাওয়ার গল্পের ইতি টানছি আমার খুব প্রিয় তিনটি উক্তি দিয়ে:
প্রথমটা "ব্যাটম্যান বিগিন্স" থেকে:
:Why do we fall, Bruce?
:So that we learn to pull ourselves up.
দ্বিতীয়টি দ্য আলকেমিস্ট এর লেখক পাউলো কোয়েলহোর:
"The meaning of life is to fall seven times and get up at eighth"
আর সর্বশেষটা টম হ্যাংক্স অভিনীত মুভি "কাস্ট এ্যাওয়ে" এর:
"I know what I have to do now. I gotta keep breathing. Because tomorrow the sun will rise. Who knows what the tide could bring?"
আমার মত হারু পার্টির স্থায়ী সদস্য যদি হাল না ছেড়ে লড়ে যেতে পারে, আপনি পারবেন না?!
এইটা কোন কথা?!?
সবাইকে শুভেচ্ছা!

সোমবার, ২৫ মে, ২০১৫

জীবন যেরকম

(আমার ফ্রেন্ড/ ফলোয়ার/ ফ্যানদের অনুরোধে আমার ৪টা স্ট্যাটাসকে নোট আকারে রেখে দিলাম।)- Sushanta Paul

https://soundcloud.com/abu-salman-mohammad-abdullah/rj-salman-reading-shushanta-pauls-status-listen-it-and-inspire-yourself
৫ মে

: দোস্তো, তুই আমার কথাটা শোন, আমি কলেজছুটির পর তোকে লিফট দেবো, তোর বাসায় আমার গাড়িতে করে নামিয়ে দিয়ে আসব।
: ধুরর্ ব্যাটা! রাখ তোর লিফট! তোর বাপের গাড়িতে তো আমি উঠবই না, নামাবি কীভাবে?


আমার ছোট্ট ফ্রেন্ড / ফ্যান / ফলোয়াররা, This is the attitude! তোমার বন্ধুর বাবার টাকায় শুধু ওকে চলতে দাও, তুমি চলো না। জীবনে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হলে অল্প বয়সেই মাথা নিচু না করে চলাটা শিখতে হয়। প্রয়োজনে না খেয়ে থাকবে, তবুও কারোর বাবার পয়সায় কখনোই একটা বার্গারও খাবে না যদি ওকেও আরেকদিন একটা বার্গার খাওয়ানোর ক্ষমতা কিংবা সুযোগ তোমার না থাকে। দাদার নামে গাধা, বাপের নামে আধা, নিজের নামে শাহজাদা। আর পরের বাপের নামে তো মহাগাধা! জীবনে যা-ই কর না কেন, পেছনে হাত দিয়ে দেখে নাও মেরুদণ্ডটা ঠিক জায়গাতে আছে তো? রেস্টুরেন্টে বসার আগেই দেখে নাও পকেটে বিল দেয়ার পয়সা আছে কিনা। যে তোমার বিল দেয়, চকোলেট কিনে দেয়, গাড়িতে লিফট দেয়, শপিং করে দেয়, মোবাইল ফোনটা ব্যবহার করতে দেয়, সে কিন্তু তোমাকে আস্তে আস্তে কিনে নেয়। একবার আত্মসম্মানবোধ বিকিয়ে দেয়ার বদ অভ্যাস করে ফেললে জীবনেও আর কোনদিন বড় হতে পারবে না। বাজি ধরে বলতে পারি, ইচ্ছেটাও নষ্ট হয়ে যাবে। জীবনে শেষ হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যেও না। শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও হলেও চেষ্টা করে যাবে। মাথা নত করে বাঁচার চাইতে মৃত্যুবরণও শ্রেয়। প্রাণ থাকতে কখনোই কারোর কাছে মাথা নত করবে না, কারোর পা চেটে চলবে না, সে ব্যক্তি যে মহারাজাই হোন না কেন! এ অভ্যাসটা করতে হবে অল্পবয়সে। নিজের বাবাকে আরেকজনের বাবার কাছে প্রাণ গেলেও ছোট হতে দিয়ো না। একদিন তোমার বাবা আর তোমাকে চালাতে পারবেন না। সেদিন তোমাকে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। পেছনের মেরুদণ্ডটা না থাকলে দাঁড়াবে কীভাবে?

৬ মে

গতকাল অফিস আর সারাদিন ঘোরাঘুরি শেষে সন্ধ্যায় অনুরোধে ঢেঁকি গিলতে হল। বিয়ানীবাজারের এক ভদ্রলোক আবদুল আলীম লোদী। (উনি ইব্রাহীম লোদীর কেউ হন নাকি?) গাছ ভালবেসে ভেষজ আর ফলজ উদ্ভিদের বাগান গড়ে তুলেছেন। উনার প্রচণ্ড ইচ্ছে, এ লোদী গার্ডেনের কথা দেশময় ছড়িয়ে যাক। সবাইকে খুব আগ্রহ নিয়ে ঘুরে ঘুরে বাগান দেখান। কালকে সন্ধ্যায় অসম্ভব টায়ার্ড ছিলাম। শুধু কাউকেই 'না' বলতে পারি না বলে উনার অনুরোধ আর আগ্রহে রাত সাড়ে ৮টার দিকে লোদী গার্ডেনে গেলাম। দেশিবিদেশি অনেক দুষ্প্রাপ্য গাছে বাগান ভর্তি। উনি টর্চলাইট জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে গাছ চেনাচ্ছিলেন। গাছ আমি নিজেও ভালবাসি, গাছের প্রতি একধরণের মমত্ব অনুভব করি। কিন্তু প্রচণ্ড শারীরিক অবসাদের কারণে অতিবিরক্ত লাগছিল। তবুও কষ্ট করে হাসিমুখে উনার কথা মন দিয়ে শোনার অভিনয় করে যাচ্ছিলাম। এমনই ঘর্মাক্ত হাসিমুখ, উনার অনুরোধে যে কয়েকটি ছবি তুলেছি তার প্রত্যেকটাতে আমাকে দেখাচ্ছে পকেটমারের মতো, দেখলেই যে কারোরই ধরে গণধোলাই দিতে ইচ্ছে করবে। গাছ নিয়ে উনার প্রচণ্ড আবেগ আর ভালবাসা সত্যিই দেখার মতো। এ পৃথিবীতে শুধু আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে মাস্টারপিস বানানো সম্ভব। সাথে প্রয়োজন অক্লান্ত পরিশ্রম করার মানসিকতা। এর সবই লোদী সাহেবের আছে। সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির বদৌলতে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। কালকে এটা আরো একবার শিখলাম।


রেস্টহাউজে ফিরলাম রাত সাড়ে ১০টার দিকে। শরীর যেন ভেঙে পড়তে চাইছে। পরদিন, মানে আজকে সকাল ৭টায় আবার ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে। এদিকে প্রথম আলো'তে শুক্রবারের চাকরিবাকরি পাতায় বিসিএস লিখিত পরীক্ষার বাংলাদেশ বিষয়াবলীর প্রস্তুতিকৌশল নিয়ে লেখাটা রেডি করে বুধবার বিকেলের মধ্যেই পাঠাতে হবে। মানে, লেখাটা যে করেই হোক, রেডি করতে হবে আজকে রাতের মধ্যেই। কিন্তু এ শরীর নিয়ে সেটি কিছুতেই সম্ভব নয়। গোসলটোসল সেরে সাড়ে ১১টার দিকে প্রথম আলো'তে ফোন দিলাম। 'অনিবার্য কারণবশত আজকের লেখাটি ছাপানো সম্ভব হল না। লেখাটি আগামী সংখ্যায় ছাপানো হবে।' আমার পক্ষে এ ক্লান্ত শরীর নিয়ে লেখাটা খুব কঠিন হবে, তাই এরকম কিছু একটা ছেপে দিতে বললাম। কিন্তু উনি জানালেন, এ মুহূর্তে এটা করা কিছুতেই সম্ভব নয়। সবাই লেখাটির জন্য অপেক্ষা করে থাকবে। একটু কষ্ট হলেও যেন দয়া করে লিখে দিই। . . . . . . সত্যিই অসহায় লাগছিল। যেমনতেমন করে তো আর লেখাও যায় না, এত লোক পড়বে! তার উপর এ ধরণের লেখা লেখার সময় আমার ভেতরে একটা প্রচণ্ড দায়িত্ববোধ কাজ করে। শওকত ওসমানের জননী পড়ছিলাম। ওটা আরো একটু পড়েটড়ে সাড়ে বারটার দিকে লিখতে বসলাম। এ বসা প্রয়োজন থেকে নয়, আবেগ থেকে, ভালবাসা থেকে, অসীম দায়িত্ববোধ থেকে। জানি বেশিক্ষণ ঘুমুতে পারব না, কালকে মোটামুটি ভোর থেকেই সারাদিন ঘোরাঘুরি করতে হবে, তবুও। ল্যাপটপে স্লো ইনস্ট্রুমেন্টাল ছেড়ে লিখতে লাগলাম। ফেসবুকিং করেটরে লেখাটা শেষ করে যখন শুতে গেলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন আড়াইটা ছুঁইছুঁই। ঘুমুতে যাওয়ার আগে মনে মনে শপথ করলাম, পরের জন্য আর না, এখন থেকে একটু নিজের জন্য বাঁচব। দুচ্ছাই! বলে সব ছেড়েছুঁড়ে দেবো! কী হবে এসব করে? সবাই তো আর ভালবাসে না, কেউ কেউ তো গালাগালিও দেয়। কী দরকার! যথেষ্ট হয়েছে! . . . . . . . নিজের উপর রাগটা একটা ভোর হওয়া পর্যন্তই! জানি, মানুষের অপরিসীম ভালবাসায় এই ভূতের বেগার খাটা কখনোই বন্ধ করে দিতে পারব না। হয়তো থমকে যাবো কখনো কখনো, তবুও থামব না। সবচাইতে বেশি কষ্ট পাই, যখন দেখি আমার কাজগুলো নিয়ে কেউ আজেবাজে মন্তব্য করছে। শারীরিক কষ্টও এতটা কষ্ট দেয় না। এসব লেখালেখি, ক্যারিয়ার আড্ডা, মোটিভেশনাল কাউন্সেলিং থেকে এ পর্যন্ত এক পয়সাও তো কোনদিনও নিইনি!


তিন ঘণ্টার মতো ঘুমিয়েছি। ৭টায় ঘুরতে বের হলাম। এখন আছি বিছানাকান্দি আর পাংথুমাইয়ের পথে। এরপর রাতারগুল, জৈয়িন্তাপুরের সাইট্রাসবাগান, রাজবাড়ি, লালাখাল। বিছানাকান্দি যাওয়ার রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বিল-হাওড়ের দূশ্যটা দেখার মতো। রাস্তার ধারে সারি সারি জেন্টলম্যান-দেখতে গাছগুলো, এরই মাঝ দিয়ে ছুটে চলা। বস্তুত জীবন তো ছুটে চলাই! হোক সুন্দরের মধ্য দিয়ে কিংবা অসুন্দরের মধ্য দিয়ে। জীবন শুধু সুন্দরই নয়, জীবন অসুন্দরও। আমার প্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্টকে মনে পড়ছেঃ জীবন সম্পর্কে আমি যা শিখেছি, সেটিকে আমি তিনটি শব্দে বলে দিতে পারি--- জীবন বয়ে চলে। দ্য শশ্যাঙ্ক রিডেম্পশনের অ্যান্ডি ডুফ্রেইনের কথাটি মাথায় রেখেও জীবনটা দিব্যি কাটিয়ে দেয়া যায়ঃ Get busy living, or get busy dying.

৭ মে

কালকের প্রথম আলো'তে বিসিএস লিখিত পরীক্ষার বাংলাদেশ বিষয়াবলীর প্রস্তুতিকৌশল নিয়ে আমার একটা লেখা থাকছে। গতসপ্তাহের লেখাটা ছিল আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর উপর। লিখিত পরীক্ষার সব বিষয় নিয়েই লেখা হয়ে গেল। এসব টেকনিকের বাইরে আরোকিছু মাথায় আসলে আমার ফেসবুক ওয়ালে শেয়ার করে দেবো। যাদের কাছে লেখাগুলো সংগ্রহে নেই, তারা আমার ওয়াল থেকে পুরোনো পোস্টেই পেয়ে যাবেন। কিছুদিন পর প্রথম আলো’তে সামগ্রিক প্রস্তুতিকৌশল আর এক্জামফিটনেস নিয়ে কিছু কথা লিখব।


এই আমিও বাংলাদেশ বিষয়াবলী আর আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী নিয়ে লিখছি! ব্যাপারটা আমার কাছে এখনো অবিশ্বাস্য লাগছে! কেন? বলছি।


আমার পেপারটেপার পড়ার অভ্যেস নেই। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়া শুরু করার আগে বিনোদন পাতা আর সাহিত্য পাতা ছাড়া পেপারের আর কোনো অংশ তেমন একটা পড়তাম না। বাসায় পেপার রাখত ২টা। এর একটাও আমি পড়তাম না। বিসিএস'য়ের প্রস্তুতির জন্য নিতান্ত বাধ্য হয়ে অনলাইনে প্রতিদিন ৫-৬টা পেপার পড়তে শুরু করি এবং চাকরিটা পেয়ে যাওয়ার পর আবারও পেপারপড়া ছেড়ে দিই। দেশের এবং বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, রাজনীতির হাওয়া কোনদিকে, ব্যবসাবাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি, এসব ব্যাপার নিয়ে আমার কোনকালেই কোন মাথাব্যথা ছিল না, আমি এর কিছুই জানতাম না, বুঝতাম না, এবং এ নিয়ে আমার কোন দুঃখবোধও ছিল না। আমার নীতি হল, আমার যা দরকার নেই কিংবা ভাল লাগে না, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। সবকিছু জানতেই হবে কেন? পৃথিবীর সবকিছু জেনেটেনে ‘সুখে আছে যারা, সুখে থাক তারা।’


বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। দেখলাম, প্রিলি আর রিটেনের জন্য হাতে সময় আছে মাত্র ৪-৫ মাস। (সময় পেয়েছিলাম এরও কম।) প্রস্তুতি শুরু করার পর আমার প্রথম অনুভূতিঃ সবাই সবকিছু পারে, আমি কিছুই পারি না। অনেকেই দেখলাম বিসিএস নিয়ে অনার্স-মাস্টার্স-পিএইচডি শেষ করে এখন পোস্টডক্টরেটে আছে। কোচিংয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর ক্লাসে এক স্যার আমাকে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নাম কী? (পরে জেনেছি, কথাটা হবে, বিদেশমন্ত্রী) যে ছেলে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নাম জানে বলে খুশিতে বাকবাকুম করতে করতে একধরণের আত্মশ্লাঘাবোধ করে, তার পক্ষে এটা জানার কথা না এবং এ না-জানা নিয়ে তার মধ্যে কোন অপরাধবোধ কাজ করার প্রশ্নই আসে না! পারলাম না। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি হাহাহিহি শুরু হয়ে গেছে। তখন বুঝলাম, ‘এটা একটা সহজ প্রশ্ন ছিল।’ স্যার বললেন, "দেখি, এটা কেউ বলতে পারবেন?" সবাই হাত তুলল, উত্তরও দিল। সবাই-ই পারে! বুঝলাম, এই মুহূর্তে আমার চেহারাটা একটু লজ্জা-পাওয়া লজ্জা-পাওয়া টাইপ করে ফেলা উচিত। আমার বেহায়া চেহারাটাকে লাজুক লাজুকটাইপ করার চেষ্টা করছি, এমনসময় স্যার বললেন, "আপনার সম্পর্কে তো অনেক প্রশংসা শুনেছি। আপনি নাকি কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, ভাল স্টুডেন্ট। এটা পারেন না কেন? আপনার এজ কত?" ভাবলাম, কাহিনী কী? উনি কি আমার ঘটকালি করবেন নাকি? কিন্তু আমার মত বেকার ছেলেকে কে মেয়ে দেবে? (আমি আসলে বেকার ছিলাম না, নিজের কোচিং সেন্টার ছিল অন্যান্য ব্যবসাও ছিল; প্রচুর টাকাপয়সা ইনকাম করতাম। কিন্তু আমাদের দেশে শিক্ষিত ছেলেরা চাকরি না করলে সবাই ভাবে, বেকার।) এসব ভাবতে ভাবতে আমার এজটা বললাম। রিপ্লাই শুনলাম, "ও আচ্ছা! আপনার তো এখনো এজ আছে। অন্তত ৩-৪ বার বিসিএস দিতে পারবেন। চেষ্টা করে যান। প্রথমবারে হওয়ার কোন সম্ভাবনাই নাই, ২-৩ বার চেষ্টা করলে হলেও হতে পারে। আপনার বেসিক দুর্বল।" স্যারকে কিছুই বললাম না। কিন্তু মেজাজ খুব খারাপ হল। উনার প্রতি সমস্ত আস্থা আর সম্মানবোধ চলে গিয়েছিল। উনাকে আমার মনে হয়েছিল একজন দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ। যে মানুষ আমাকে না চিনেই প্রথম দেখায় এমন কনফিডেন্টলি ফাউল একটা অ্যাসেসমেন্ট করতে পারে, তার ক্লাস করার তো প্রশ্নই আসে না, সে উনি যত ভাল ক্লাসই নিন না কেন! আমি কিছু পারি না, এটা তো আমি জানিই! এজন্যই তো কোচিংয়ে আসা। পারলে কি আসতাম নাকি? আমি একটা গাধা, এটা শোনার জন্য এত কষ্ট করে, সময় নষ্ট করে, গাড়ি ভাড়া দিয়ে বাসা থেকে কোচিংয়ে এসেছি নাকি? এটা শুনতে তো আর এতদূর আসতে হয় না। বাসায় বসে থাকলে মা দিনে অন্তত ১০বার একথা বলে! তখনই ঠিক করে ফেললাম, ব্যাটার ক্লাস আর কোনদিনও করব না। করিওনি।


পরে জানলাম, উনি অংক-ইংরেজি-বাংলা-বিজ্ঞানে অতিদুর্বল সাধারণ জ্ঞানে মহাপণ্ডিত ৫বার বিসিএস'য়ে ব্যর্থ একজন বিশিষ্ট বিসিএস বিশেষজ্ঞ। শুধু নিজেরটা ছাড়া পৃথিবীর সকল মানুষের ব্যর্থতার কারণগুলি তিনি খুঁজে দিতে পারেন। উনি জানতেন, সুশান্ত সাধারণ জ্ঞানের কিছুই পারে না। কিন্তু উনি এটা জানতেন না, সুশান্ত বাংলা-ইংরেজি-অংক-বিজ্ঞান ওসব বিষয়ে অনার্স মাস্টার্স করা যেকোনো স্টুডেন্টের চাইতে ভাল না পারলেও কোন অংশেই কম পারে না। উনি এটাও জানতেন না, শুধু সাধারণ জ্ঞানে তোতাপাখি হয়ে বিভিন্ন খাঁচায় বসে বসে মনভোলানো নানাঢঙে ডাক দেয়া যায়, কিছু হাততালিও জুটে যায়, কিন্তু বিসিএস ক্যাডার হওয়া যায় না। ক্লিনটনের ওয়াইফের বান্ধবীর পোষা কুকুরের নামও আপনার মুখস্থ, কিন্তু আমার নানার একটা কালো কুকুর ছিল’কে ইংলিশে লিখেন, My grandfather was a black dog……… কোনো কাজ হবে না। সত্যি বলছি, কোনো কাজই হবে না।


কোচিংয়ে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর প্রথম মডেল টেস্টে পেলাম ১০০'র মধ্যে ১৭! বলাই বাহুল্য, আমার মার্কসটাই ছিল সর্বনিম্ন। সেকেন্ড লোয়েস্ট মার্কসটা ছিল ৩৮; আমার প্রাপ্ত মার্কসের দ্বিগুণের চেয়েও ৪ বেশি! বুঝুন আমার অবস্থাটা! বাকিরা আমার অনেকআগে শুরু করেছে, আমি তো বিসিএস কথা জীবনেও শুনি নাই, আমি তো মাত্র শুরু করলাম----নিজেকে খুশি করার জন্য এসব কথা ভাবতেই পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। ভাবলাম, ঠিক আছে, আমি না হয় কিছু পারি না, সেটা তো আর আমার দোষ না। কিন্তু আমি যদি সে দুর্বলতাকে জয় করার জন্য কিছু না করি, হাতপা গুটিয়ে বসে থাকি, সেটা তো নিশ্চয়ই আমার দোষ! প্রচণ্ড পরিশ্রম করে পড়াশোনা করতে শুরু করলাম একেবারে জিরো থেকে। কে কী পারে সেটা ভেবে মন খারাপ না করে দুটো ব্যাপার মাথায় রেখে কাজ করতে লাগলাম। এক। সবাই যা পারে, সেটা পারাটা আদৌ কতটুকু দরকার। অন্ধের মত না পড়ে একটু বুঝেশুনে পড়তে শুরু করলাম। সবাই যা যা পড়ে, আমাকেও তা-ই তা-ই পড়তে হবে, এটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললাম। দুই। সাধারণ জ্ঞানে ভাল কারোর সাথে নিজেকে তুলনা না করে নিজের সাথেই নিজেকে তুলনা করা শুরু করলাম। গতকালকের সুশান্তের চাইতে আজকের সুশান্ত কতটা বেশি কিংবা কম পারে, শুধু সেটা নিয়েই ভাবতাম। আমার কম্পিটিশন হতো আমার নিজের সাথেই। অন্যকাউকে না, ‘আজকের আমি’ ‘আগেরদিনের আমি’কে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। কাজটা প্রতিদিনই করতাম। যারা ভাল পারে, তারা তো আর রাতারাতি এত ভাল পারে না। অনেক পরিশ্রম আর সাধনার পর এ দক্ষতা অর্জন করা যায়। যে স্টুডেন্টা অংকে ২০ পায়, সে যদি কখনো অংকে ২৪ পেয়ে যায়, তবে সে কিন্তু সাকসেসফুল। জানি, ৩৩ পেলে পাস, সে ফেল করেছে; তবুও আমি বলব, সে কিন্তু সফল। সে তো নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে। এভাবে করে একদিন সে ১০০'তে ১০০-ই পাবে! এরজন্য ওকে বুঝেশুনে প্রচুর প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে এবং এটাকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। মজার ব্যাপার হল, জেতাটা একটা অভ্যাস। যে একটা চাকরি পেয়ে যায়, সে চাকরি পেতেই থাকে। এই ফাঁকে জানিয়ে রাখি, হারাটাও কিন্তু একটা অভ্যাস। ভাল কথা, যারা কোচিং করছেন, কোচিংয়ে মার্কস কমটম পেলে মন খারাপ করবেন না। অনেকেই মেয়েদের কাছে হিরো হওয়ার জন্য আগে থেকে প্রশ্ন যোগাড় করে ‘পরীক্ষা’ দেয়। কোচিংয়ের প্রশ্ন যোগাড় করা তো কোন ব্যাপার না। এইরকম অনেক বান্দাকে আমি সেইরকমভাবে ধরা খেতে দেখেছি।


যে ছেলে কোনদিনও ঠিকভাবে বিসিএস'য়ের নামও শোনেনি, যে ছেলে জীবনেও কোন চাকরির পরীক্ষাই দেয়নি, সে ছেলে যদি বিসিএস পরীক্ষায় প্রথমবারেই ফার্স্ট হতে পারে, তবে আপনি কেন পারবেন না? ফার্স্ট হওয়াটা ভাগ্যে জুটুক আর না-ই বা জুটুক, মনপ্রাণ বাজি রেখে চেষ্টা করলে অন্তত চাকরিটা তো জুটবেই। ভাবছেন, খুব হেসেখেলে ফার্স্ট হয়ে গেছি? কিছুতেই না! এর জন্য অনেকরাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়েছে। অনেক ছোট ছোট সুখকে গুডবাই বলে দিতে হয়েছে। মুখ বন্ধ রেখে মানুষের বড় বড় কথা হজম করে পড়াশোনা করতে হয়েছে।


আমি বিশ্বাস করি, আপনারাও পারবেন। যারা চাকরি পায়, ওরা আপনাদের চাইতে কোনোভাবেই বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন নয়। নিজের উপর আস্থা রাখুন, নিজেকে সম্মান করুন, আপনার স্বপ্ন পূরণ করার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করুন। বাকিটা সৃষ্টিকর্তার হাতে!


গুড লাক!

৮ মে

একটি সত্যি ঘটনা শেয়ার করছি।


একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামের একটা মেয়ে। এসএসসি’তে ৩.৮৮, মানে মাঝারি ধরণের রেজাল্ট। বাড়ির কাছাকাছি একটা মোটামুটি মানের থানার কলেজে ভর্তি হয়ে গেল। কাছাকাছি মানে কিন্তু বাড়ি থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে। কোন যানবাহন নেই, হেঁটে যেতে হয়; বৃষ্টির সময় হাঁটুকাদার মধ্য দিয়ে। ওর অনেক ক্লাসমেটই ছোটবেলা থেকে ঠিকমতো টিচার পেয়েছে, কোচিংয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে, সচেতন বাবা-মা’র সন্তান বলে পড়াশোনা কীভাবে করতে হয় সেটাও জানতে পেরেছে আগে থেকেই। মেয়েটা এতকিছু কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। কখনো কারোর কাছে প্রাইভেট পড়ার সামর্থ্য কিংবা সুযোগ কোনটাই তার ছিল না। একদিন কলেজের ইংরেজি শিক্ষক মেয়েটাকে বললেন, “তুমি আমার ব্যাচে আস।” মেয়েটা সাথে সাথেই বলল, “না স্যার! আপনার ব্যাচে যারা পড়ে, ওরা ইংরেজিতে অনেক ভাল। আমি কিছুই পারি না স্যার। আমি যাবো না।” স্যার জোর দিয়ে বললেন, “তুমি আস কালকে সকালে। বাকিটা পরে দেখা যাবে।” মেয়েটা পরেরদিন অনেক সংকোচ নিয়ে কোচিংয়ে গেল। একে তো গ্রাম্য মেয়ে, ঠিকমতো কথাও বলতে জানে না, তার উপর ইংরেজিতে অতি দুর্বল। ও গিয়ে দেখল কোচিংয়ের স্টুডেন্ট প্রায় ৩০ জন; সবাই ওর চাইতে অনেক ভাল ইংরেজি পারে। ও নিয়মিত যেতে থাকল। ও লজ্জায় কথাও বলতো না। যেত, এককোনায় চুপচাপ বসে বসে ক্লাস করত, আর ছুটি হলে কলেজে যেত।


একদিনের ঘটনা। ও ক্লাসে একটা ইংরেজি শব্দ ভুল উচ্চারণ করল। এতে তার এক ক্লাসমেট এত জোরে হাসল যা তার এখনো মাথায় বাজে। সেদিন ও এতই কষ্ট পেয়েছিল যে কোচিং শেষে আর কলেজে যায়নি, বাড়িতে এসে রুমের দরোজা বন্ধ করে অনেকক্ষণ কাঁদল। সেদিনই ও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যে করেই হোক, ও ইংরেজি শিখবেই! প্রচণ্ড ইচ্ছেশক্তি আর পরিশ্রম করে সে পড়াশোনা করতে শুরু করল। ওর ইংরেজির শিক্ষক ওকে সবসময়ই উৎসাহ দিতেন, আর সাহায্য করতেন। ওর একটাই ইচ্ছে ছিল, যে করেই হোক, ও ওর ক্লাসমেটদের চাইতে ১ মার্কস হলেও বেশি পাবে! সে জীবন বাজি রেখে চেষ্টা করত। এভাবে করে ক্রমাগত চেষ্টায় ও ওদের কলেজে একটা টার্ম পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে গেল। এবং এরপর থেকে প্রতিবারই ফার্স্ট হতো। যে মেয়ে একটা সময়ে ইংরেজি শব্দ উচ্চারণও করতে পারত না, একেবারে সহজ গ্রামারও বুঝত না, ভোকাবুলারির অবস্থা ছিল শূন্যের কোঠায়, সে মেয়েটিই এইচএসসি’তে ইংরেজিতে এ+ পেল; ওর মার্কস ছিল ওর কলেজে সর্বোচ্চ। ওর জেদ ছিল ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সেই ইংরেজি’তেই অনার্স-মাস্টার্স করবে। এবং পরবর্তীতে সেটাই করল।


আরেকটা ঘটনা ওর জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার পর রেজাল্ট বের হওয়ার আগে ও একটা অ্যাডমিশন টেস্ট কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিল। ক্লাসে তেমন কোন কথা বলতো না। স্যাররা যা জিজ্ঞেস করতেন, শুধু সেটারই উত্তর দিত। একদিন ক্লাসে এক স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবা কী করেন?” ও গর্বের সাথে উত্তর দিল, “কৃষিকাজ করেন।” সেই স্যার তখন তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার সাথে জিজ্ঞেস করলেন, “মানে কৃষক?” মেয়েটা বলল, “জ্বি স্যার।” “তাহলে উনি তো নিশ্চয়ই পড়াশোনা জানেন না। তা, তোমাকে বাড়িতে কে পড়ায়?” এসব শুনে ওর ক্লাসমেটরা হাসাহাসি করছিল। অনেক কষ্টে কান্না চেপে “স্যার, আমি নিজেই পড়ি, আমার বড় ভাই সবসময়ই আমাকে উৎসাহ দেন।” এইটুকু বলেই এইটুকুন মেয়েটা বসে পড়ল। অ্যাডমিশন টেস্টের রেজাল্টের পর কোচিং থেকে ওকে ফোন করেছিল ছবি তোলার জন্য। ওদের ব্যাচ থেকে একমাত্র ও-ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছিল। কোচিংয়ের লিফলেটে ওর দরিদ্র নিরক্ষর কৃষক বাবার সাথে ওর ছবি ছাপা হয়েছিল। সেদিন ব্যাচে ওর এক ফ্রেন্ড ওর বাবার পরিচয় দেয়ার জন্য ওকে গাধী বলে বকাঝকা করেছিল, এবং বলেছিল, এই পরিচয়টা ‘ট্যাক্টফুলি’ এড়িয়ে গেলেই ভাল হয়। আর সে মেয়েই এখন ওর কৃষক বাবা আর ওর গ্রাম্য যৌথ পরিবার নিয়ে সবাইকে মাথা উঁচু করে গর্বের সাথে বলতে পারে। সেই ছোট্টো মেয়েটা ওর অসাধারণ সুন্দর গ্রাম্য পরিবার নিয়ে সারাজীবনই গর্ব করে যাবে।


যে দেশে কৃষকের সন্তান প্রাপ্য সম্মান পায় না, যে দেশে বিয়ের সময় উচ্চ বংশজাত নিম্ন অবস্থান আর রুচির পাত্রপাত্রীরাও প্রাধান্য পায়, যে দেশে ‘খারাপ’ স্কুলকলেজ থেকে পাসকরা স্টুডেন্টদেরকে ‘খারাপ’ স্টুডেন্ট বলে ধরে নেয়া হয়, যে দেশে বাইরের চাকচিক্য দিয়ে এখনো মানুষ বিচার করা হয়, যে দেশে ফালতু বাহ্যিক স্মার্টনেস দেখানো ফাউল ছেলেপেলেদের মূল্যায়ন করা হয়, যে দেশে বড়লোকের সন্তানই শুধু বড় চেয়ারটা পায়, যে দেশে মেরুদণ্ডহীন ছেলেরা বসে থাকে বিয়ের পর মেয়ের বাবার টাকায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশায়, আমি বিশ্বাস করি, সে দেশ আর যা-ই হোক, বেশিদূর যেতে পারে না। এটা সত্যিই খুব লজ্জার। আমাদের দেশের এই করুণ দুর্দশার জন্য আমাদের মানসিকতাই দায়ী।


আমি নিজেও চট্টগ্রামের সবচাইতে ‘বাজে’ স্কুলগুলোর একটি চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল মডেল হাই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। স্কুলটাকে সবাই অবজ্ঞা করে ‘বালতি স্কুল’ বলে ডাকে। আমাকে অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য সহ্য করতে হয়েছে। টুডে আই অ্যাম প্রাউড অব মাই ‘বালতি স্কুল’!!


বড় বড় কথাবলা অল্পবয়েসি ছেলেমেয়েরা! এই বড় ভাইয়ার কথা বিশ্বাস কর, দিন সারাজীবন এরকম থাকবে না। যেদিন তোমাদের সমাজের কাছে মাথা নিচু করে চলতে হবে, সেদিন তুমি কোথায় পালাবে? সময় থাকতে এখুনি নিজের অবস্থান শক্ত করার জন্য চেষ্টা কর। যারা তোমাকে তোয়াজ করে, তারা কোন স্বার্থে এ কাজটা করে, সেটা একটু ভেবে দেখ। জীবনটা সবসময়ই এভাবে করে যাবে না। তোমার মা-বাবা’কে সমাজের কাছে সম্মানিত করার চেষ্টা কর। পৃথিবীর কাছে নোবডি হয়ে বেঁচে থাকাটা যে কতটা গ্লানির আর কষ্টের, সেটা আমি খুব ভাল করে জানি। মানুষকে সম্মান কর, বিনীত হতে শেখো, আর প্রচুর পরিশ্রম করার অভ্যেস গড়ে তোলো। জীবনটাকে এখন চাবুকপেটা করার সময়, উপভোগ করার নয়। তোমাদের জন্য শুভকামনা রইলো।

https://www.facebook.com/notes/sushanta-paul/%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%AE/10152711958337038?pnref=story

মঙ্গলবার, ১৯ মে, ২০১৫

বোর্ড পরীক্ষার সার্টিফিকেট হারিয়ে গেলে আপনার করনীয়

একটি ছাত্রের শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ সার্টিফিকেট আর তা হারিয়ে গেলে ভীষণ চিন্তায় পড়ে যান অনেকেই। কী করবেন, কিভাবে সার্টিফিকেট ফিরে পাবেন তা বুঝতে পারেন না। সার্টিফিকেট বা এ ধরনের মূল্যবান শিক্ষাসংক্রান্ত কাগজপত্র হারালে বা নষ্ট হয়ে গেলে ঘাবড়ানোর কিছু নেই।
প্রথমে যা করবেনঃ
সার্টিফিকেট, নম্বরপত্র বা প্রবেশপত্র হারিয়ে গেলে দেরি না করে এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এর জন্য প্রথমে আপনার এলাকার নিকটবর্তী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে হবে।
জিডির একটি কপি অবশ্যই নিজের কাছে রাখতে হবে। এরপর যেকোনো একটি দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে। বিজ্ঞপ্তিতে নাম, শাখা, পরীক্ষার কেন্দ্র, রোল নম্বর, পাসের সাল, বোর্ডের নাম এবং কিভাবে আপনি সাটিফিকেট, নম্বরপত্র অথবা প্রবেশপত্র হারিয়েছেন তা সংক্ষেপে উল্লেখ করতে হবে।
থানায় জিডি ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর আপনাকে যেতে হবে যে বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দিয়েছেন সেই শিক্ষা বোর্ডে। শিক্ষাবোর্ডের ‘তথ্যসংগ্রহ কেন্দ্র’ থেকে আবেদনপত্র সংগ্রহের পর নির্ভুলভাবে পূরণ করতে হবে। এরপর নির্ধারিত ফি সোনালী ব্যাংকের ডিমান্ড ড্রাফটের মাধ্যমে বোর্ডের সচিব বরাবর জমা দিতে হবে। টাকা জমা হওয়ার পর আবেদন কার্যকর হবে। আবেদনপত্রের সঙ্গে মূল ব্যাংক ড্রাফট, পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির কাটিং ও থানার জিডির কপি জমা দিতে হবে।
আবেদনপত্রে যা পূরণ করতে হবেঃ
আবেদনপত্র পূরণের ক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হবে আপনি কোন পরীক্ষার (মাধ্যমিক না উচ্চমাধ্যমিক) কী হারিয়েছেন এবং কী কারণে আবেদন করছেন। আবেদনপত্রের বিভিন্ন অংশে ইংরেজি বড় অক্ষরে এবং বাংলায় স্পষ্ট অক্ষরে পূর্ণ নাম, মাতার নাম, পিতার নাম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম, রোল নম্বর, পাশের বিভাগ/জিপিএ, শাখা, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, শিক্ষাবর্ষ এবং জন্মতারিখ সহ বিভিন্ন তথ্য লিখতে হবে।
পরবর্তী অংশে জাতীয়তা, বিজ্ঞপ্তি যে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে সেটির নাম ও তারিখ এবং সোনালী ব্যাংকের যে শাখায় ব্যাংক ড্রাফট করেছেন সে শাখার নাম, ড্রাফট নম্বর ও তারিখ উল্লেখ করতে হবে। আবেদনপত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানের সুপারিশের প্রয়োজন হবে। এতে তার দস্তখত ও নামসহ সিলমোহর থাকতে হবে। আর প্রাইভেট প্রার্থীদের আবেদনপত্র অবশ্যই গেজেটেড কর্মকর্তার স্বাক্ষর ও নামসহ সিলমোহর থাকতে হবে।
নষ্ট হয়ে যাওয়া সনদপত্র/নম্বরপত্র/একাডেমিক ট্রান্সক্রিপ্টের অংশবিশেষ থাকলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিতে হবে না বা থানায় জিডি করতে হবে না। এ ক্ষেত্রে আবেদনপত্রের সঙ্গে ওই অংশবিশেষ জমা দিতে হবে। তবে সনদে ও নম্বরপত্রের অংশবিশেষে নাম, রোল নম্বর, কেন্দ্র, পাশের বিভাগ ও সন, জন্ম তারিখ ও পরীক্ষার নাম না থাকলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। আর বিদেশি নাগরিককে ব্যাংক ড্রাফটসহ নিজ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আবেদন করতে হবে।
কত টাকা লাগবেঃ
সাময়িক সনদ, নম্বরপত্র, প্রবেশপত্র ফি (জরুরি ফিসহ) ১৩০ টাকা। এ ছাড়া ত্রি-নকলের জন্য ১৫০ টাকা এবং চৌ-নকলের জন্য ২৫০ টাকা ব্যাংক ড্রাফটের মাধ্যমে জমা দিতে হয়।

জাতীয় পরিচয়পত্র (ন্যাশনাল আইডি কার্ড) এর ছবি পরিবর্তন তথ্য পরিবর্তন ও নতুন ভোটার হোন অনলাইনে

বাংলাদেশে যত জাতীয় পরিচয়পত্র (ন্যাশনাল আইডি কার্ড) আছে ৯৯% ছবি অস্পষ্ট ও ২০% জাতীয় পরিচয়পত্রে তথ্য ভুল রয়েছে, আমি আজ আপনাদের দেখাবো কিভাবে ঘরে বসেই অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র বা ন্যাশনাল আইডি কার্ডের বিস্তারিত ডিটেইলস দেখতে পারবেন, ছবি পরিবর্তন, ঠিকানা পরিবর্তন, ভুল সংশোধন ও তথ্য হালনাগাদ করতে পারবেন ও কিভাবে অনলাইনে নতুন ভোটার হওয়ার আবেদন ফরম পূরণ করা যাবে ।
National ID Card Bangladeshএই পোস্টটি পড়ে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রের বিস্তারিত দেখে নিন এবং ফেসবুকে শেয়ার করে বন্ধুদের অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্র ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ছবি পরিবর্তন তথ্য পরিবর্তন ও নতুন ভোটার হবার বিস্তারিত নিয়মকানুন জানিয়ে দেন ।

আজকে দেখাবো অনলাইনে জাতীয় পরিচয়পত্রের কি কি পরিবর্তন আপনি নিজেই করতে পারবেন ?