শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫

পিচাই যেন বলিউডি ছবির নায়ক

সুন্দর পিচাই গত বছর যখন গুগলের অ্যান্ড্রয়েড, সার্চ, ম্যাপস—এসব পণ্যের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেলেন, ব্লুমবার্গ থেকে তাঁকে ‘মোবাইলের জগতে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ল্যারি পেজ তাঁর হাতে গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর সে কথাই সত্যি হয়েছে।
পিচাইয়ের গল্প যেন বলিউডের কোনো ঘটনা। রুপার চামচ মুখে নিয়ে তিনি জন্মাননি বটে, কিন্তু বুদ্ধিমত্তা আর কাজের গুণে আজ বিশ্বের অন্যতম কাঙ্ক্ষিত আসনে পৌঁছেছেন।
খুব সাধারণ একটি পরিবারে জন্ম সুন্দর পিচাইয়ের। জন্মের আগে তাঁর মা স্ট্যানোগ্রাফার হিসেবে কাজ করতেন। বাবা রঘুনাথ পিচাই ছিলেন একটি কারখানার বিদ্যুৎমিস্ত্রি।
সুন্দরের ছেলেবেলার কথা স্মরণ করে রঘুনাথ বলেন, ‘অফিস থেকে এসে আমি ওর সঙ্গে গল্প করতাম। অফিসের নানা ঘটনার কথা বলতাম ওকে। ও যখন একটু বড় হলো, আমার কাজ সম্পর্কে তার আগ্রহ বাড়তে থাকল। আমার মনে হয়, এখান থেকে ওর প্রযুক্তির প্রতি ঝোঁক তৈরি হয়েছে।’
সুন্দর পিচাইদের ছিল চারজনের পরিবার। দুই কামরার ছোট্ট একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। একটিতে ছোট ভাইকে নিয়ে সুন্দর ঘুমাতেন। ছোটবেলায় তাঁদের বাড়িতে কোনো টিভি ছিল না। ছিল না গাড়ি। যাতায়াতের জন্য তাঁকে সব সময় বেছে নিতে হয়েছে বাস বা বাবার স্কুটার। কোথাও যেতে হলে এক স্কুটারে চারজনকে যেতে হতো। এ যেন বলিউডের কোনো চিত্রনাট্য, যেখানে ছোট্ট এক ফ্ল্যাট থেকে সিলিকন ভ্যালিতে উড়ে আসা।

সুন্দরের বয়স যখন ১২ বছর, তখন তাঁর পরিবারে প্রথম টেলিফোন সেট আসে। এই টেলিফোন প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে দেয়। যে নম্বরে সুন্দর ডায়াল করতেন, তাই মনে রাখতে পারতেন। পিচাই বলেন, ‘চাচা কারও ফোন নম্বর ভুলে গেলে আমাকে কল দিতেন এবং তাঁর ফোন নম্বরটি জিজ্ঞাসা করতেন। তবে সেটি সত্যিই কাজের কি না, আমি নিশ্চিত ছিলাম না।’
সুন্দর পিচাইয়ের সংখ্যা মনে রাখার একটি দারুণ গুণ আছে। গুগলের প্রকৌশল বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যালন উইস্ট্যাস বলেন, ‘সম্প্রতি এক সভায় ভয়েস সার্চবিষয়ক কিছু পরিসংখ্যান গড়গড় করে বলে গেলেন সুন্দর পিচাই। এ বিষয়টি নিয়ে আমি কাজ করি। অথচ আমি যে সংখ্যাটি জানি না সেটিও দেখি সে জানে!’
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো ছিলেন সুন্দর। আইআইটি খড়গপুরে স্নাতকে ভালো ফলাফল করেন। স্ট্যানফোর্ডে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড সেমি কন্ডাক্টর ফিজিকস নিয়ে পড়ার জন্য বৃত্তি পান। স্কুলে বরাবর ভালো ফল করা সুন্দর ছিলেন ক্রিকেট ক্যাপ্টেন। ফুটবলের দারুণ ভক্ত। এরপর আইআইটি খড়্গপুর। যেখানে প্রায়ই তাঁকে দেখা গেছে ক্ষয়ে আসা হাওয়াই চপ্পল পায়ে। এ নিয়ে ভাবেননি। পড়াশোনা করেছেন মন দিয়ে। তাঁর স্কুলের এক শিক্ষক বলেন, ‘প্রতিটি নম্বরের জন্য যুদ্ধ করেছে সুন্দর। বিশেষ করে গণিত ও পদার্থবিদ্যায়। কখনো ভুল করলে তা শুধরে বারবার করার চেষ্টা করেছে।’
বিদেশে পড়তে গেলে যে খরচ, তা নিয়েই সমস্যায় পড়তে হয় সুন্দরের বাবাকে। বিমানের টিকিট, থাকা-খাওয়ার খরচ—সব মিলিয়ে অনেক টাকার দরকার। কিন্তু ঋণ জোগাড় করতে পারেননি বাবা। তবু হাল ছাড়েননি। নিজের অ্যাকাউন্ট প্রায় খালি করে তুলে দিয়েছেন জমানো টাকা। যা তখন তাঁর এক বছরের বেতনের থেকেও বেশি। পিচাই বলেন, ‘এ অবস্থায় আর দশজন মা-বাবা যেটা করেন আমার মা-বাবাও তাই করলেন। আমার পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য তাঁদের জীবনের অনেক স্বপ্নই আমার জন্য বিসর্জন দিলেন।’
১৯৯৩ সালে স্ট্যানফোর্ডে পৌঁছানোর পর একটা ব্যাকপ্যাক কেনার দরকার পড়ল সুন্দরের। যখন জানতে পারলেন এর দাম ৬০ মার্কিন ডলার তখন তিনি একেবারেই দমে গেলেন। পরে পুরোনো একটি ব্যাকপ্যাক জোগাড় করে কাজ চালিয়েছেন তিনি। স্ট্যানফোর্ডে যাওয়ার পর প্রথম বছর একজনের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করেছেন।
সুন্দরের জীবনে অবশ্য প্রেমও এসেছে। বান্ধবী অঞ্জলির সঙ্গে প্রেম হয়েছিল তাঁর। স্ট্যানফোর্ডে থাকার দিনগুলো কেটেছে বিরহে। তবে পরে বিয়ে করেছেন অঞ্জলিকে।
সুন্দর পিচাই ভারতীয় চলচ্চিত্রের দারুণ ভক্ত। গত বছর গুগলের ক্যাম্পাসে ডেকেছিলেন বলিউডের অভিনেতা শাহরুখ খানকে। শাহরুখ খান ওই সময় ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ ছবির শো নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। শাহরুখ খানকে প্রশ্ন করেছিলেন, তিনি যদি অভিনেতা না হতেন তবে কী করতেন? শাহরুখ বলেন, খেলোয়াড় হতাম। অবশ্য শাহরুখ ওই অনুষ্ঠানে জানান, সুন্দরের মতো প্রকৌশলী হওয়ার শখ তাঁরও ছিল। তাই আইআইটিতে পরীক্ষাও দিয়েছিলেন। ইলেকট্রনিকস বিষয়ে ১০০তে ৯৮ নম্বরও তুলেছিলেন তিনি।
স্ট্যানফোর্ডে পিএইচডি সম্পন্ন করে অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ার গড়ার চিন্তা করেছিলেন সুন্দর পিচাই। তবে পরে সে চিন্তা থেকে সরে গিয়ে সিলিকন ভ্যালির সেমিকন্ডাক্টর নির্মাতা অ্যাপ্লাইড ম্যাটেরিয়ালসে চাকরি নেন। এরপর ২০০২ সালে পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করার পরিকল্পনা করেন। ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল গুগলে চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে আসেন। ওই দিন গুগল বিনা মূল্যের মেইল সেবা জিমেইল চালু করে। পিচাই বলেন, তিনি গুগলের এই জিমেইলকে ভেবেছিলেন ‘এপ্রিল ফুল’ বানাতে, গুগল যে ধরনের মজা করে জিমেইল সেরকমই একটা কিছু হবে।
গুগলে চাকরি হয়ে যায় সুন্দরের। এরপর ধীরে ধীরে পরিচিত হন গুগলের করপোরেট সংস্কৃতির সঙ্গে। নতুন নতুন ধারণা দিয়ে গুগলের প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি পেজের আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। মারিসা মেয়ার, অ্যান্ডি রুবিন, কামাঙ্গার, হুগো বাররা, ভিক গানডোটরার মতো সহকর্মীদের পেছনে ফেলে তরতর করে উঠতে থাকেন ওপরের পদে। ২০১৫ সালের আগস্টে এসে গুগলের সিইও তিনি।

http://www.prothom-alo.com/technology/article/602539/%E0%A6%AA%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BE%E0%A6%87-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AC%E0%A6%B2%E0%A6%BF%E0%A6%89%E0%A6%A1%E0%A6%BF-%E0%A6%9B%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A6%95

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন